উদ্যোক্তা উন্নয়ন নির্দেশিকা
লেখক: ড. মোঃ সবুর খান
বিষয়: ব্যবসা ও বিনিয়োগ, ব্যবসা ও অর্থনীতি, ব্যবসা
একটি উন্নয়নশীল ও ক্রমসমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক কর্মক্ষেত্রে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশ সরকার জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণার সাথে সাথে ২০২১ সালের মধ্যে দ্বিগুণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তার দৃঢ় সিদ্ধান্তের কথা ব্যক্ত করেছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেসরকারি খাতের ভূমিকার কথাও এখানে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে, যা কিনা জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের দায়িত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যার মোট জনসংখ্যার মধ্যে শতকরা ৫৫ জন তরুণ এবং এ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের মত দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। বর্তমানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মধ্যে ১.৩ বিলিয়ন মানুষের বয়স ১৫ থেকে ২৪ এর মধ্যে যেটি পুরো জনসংখ্যার ২০ শতাংশ এবং এদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ তরুণ উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক। তরুণদের মাঝে বেকারত্বের হার প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় প্রায় তিনগুণ এবং মোট বেকার জনগোষ্ঠীর ৪৪ শতাংশই তরুণ। মোট শ্রমশক্তির মাত্র ২৫ শতাংশ হচ্ছে তরুণ। আজকের তরুণ সমাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করার পরও বেকার থাকছে। চাকুরী বাজারের উপযোগী করে নিজেকে প্রস্তুত করা, নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাব্য ঝুঁকি হ্রাস করা, আত্মত্মবিশ্বাস অর্জন এবং একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণ সমাজকে তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং নিজের যোগ্যতাকে অনুধাবন করে নতুন কিছু শুরু করতে হবে। বাংলাদেশে সরকারের জাতীয় কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে প্রশিক্ষণ এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে জনগণের মাঝে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। শিক্ষিত বেকার তরুণ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা যার আশু সমাধান জরুরি। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় "এন্টপ্রেনিউরশীপ /উদ্যোক্তা" একটু ঝুঁকিপূর্ণ তবে স্বীকৃত ধারণা। অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশেষত একবিংশ শতাব্দীতে শিল্প-কারখানা বৃদ্ধিতে উদ্যোক্তাগণ ধারাবাহিকভাবে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশে উদ্যোক্তা উন্নয়নের যথেষ্ট সম্ভাবনা ও প্রয়োজনীয় সুযোগ রয়েছে। এদেশের শিক্ষিত তরুণের মধ্যে অনেকের মাঝেই উদ্ভাবনীশক্তি, ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা, অর্থনৈতিক সুবিধাসমূহের বিষয়ে কার্যকরী উপলব্ধি, দৃঢ় প্রত্যয় এবং বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা রয়েছে। এ সকল তরুণ পর্যাপ্ত সুযোগ পেলে অচিরেই সফল উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য পৃথিবীর তরুণ প্রজন্য যখন উদ্ভাবনী শক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সাবলম্বী হতে চায়, বাংলাদেশে সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে আমাদের তরুন প্রজন্ম Non Produc tive যায়গায় কাজ করার কারণে হতাশাগ্রস্থ হয় যার ফলে সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। যায়গা, জমি, মধ্যস্বত্ব ভোগী থেকে অতিমাত্রা মনোযোগের কারণে তা পরিমার্জিত হচ্ছে। অপশক্তির কারণে তরুণ ব্যস্ত থাকে তার উদ্ভাবণী শক্তির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হবার জন্য। আর্থিক প্রতিষ্ঠান তথা, ব্যাংক এবং অন্যান্য সহযোগি প্রতিষ্ঠানের তাদের চিন্তা চেতনার পরিবর্তন আনয়ন জরুরী কেননা একজন উদ্যোক্তাকে উদ্যোক্তা হিসেবে মূল্যয়ণ করতে হবে। তার আর্থিক বা অবস্থার মানদন্ডে নয়। তাদেরকে সামান্য সহযোগিতার মাধ্যমে যে অভাবনীয় সাফল্য বয়ে আনা সম্ভব তা সত্যি প্রশংসনীয়। আজকের বিশ্বে অনেক ধরণের অনানুষ্ঠানিক অথবা ঘরোয়া ব্যবসার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে আমাদের রয়েছে বিভিন্ন ধারার দক্ষতা সম্পন্ন জনবল। এই বিশাল তরুণ সমাজ তাদের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে অভাবনীয় কিছু সৃষ্টি করতে পারে। কেবলমাত্র সৃষ্টিশীলতার সাথে জ্ঞানের সংযোগ ঘটানোর অভাবে আমরা তাদেরকে যথেষ্ট কর্মক্ষম করে তুলতে পারছি না। Venture capital & Angel Inves- tor নেটওয়ার্ক এর মাধ্যমে এর পরিবর্তন আনা সম্ভব। আত্মপ্রত্যয়ী সৃষ্টিশীলরাই কেবল এই বিক্ষিপ্ত ধারনা গুলোকে একত্রিত করে একটি নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগের সৃষ্টি করতে পারে। কিছু উদ্যমী বিনিয়োগকারী এরই মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে শুরু করলেও তারা এখনও সবার নজরে আসছেন না। তাই সম্ভাব্য সকল সুযোগ সমূহকে বাস্তবরূপ দেওয়ার জন্য এখনই সৃষ্টিশীল ধারনাগুলোকে একীভূত করে সকলের সামনে উপস্থাপন করা উচিত। তরুণ উদ্যোক্তাগণের প্রথম পর্যায়ে কাজ শুরুর জন্য প্রচুর আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। ঝুঁকিপূর্ণ পুঁজিবাদী হল ব্যবসার আরেক রুপ। যেখানে অ্যাঞ্জেল বিনিয়োগকারী হল অলিখিত সাহসী পুঁজিবাদী আর ঝুঁকিপূর্ণ পুঁজিবাদী ব্যবসা হল একটি নিয়মতান্ত্রিক তহবিল যেটা বহুমাত্রায় বিনিয়োগের মাধ্যমে ৪-৮ বছরের মধ্যে (Initial Public Offering -IPO অর্থাৎ Share Market থেকে পুজি সংগ্রহকে বুঝায়) বাজারে প্রবেশ করে। নিয়মের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পুঁজিবাদী ব্যবসা বাংলাদেশে সীমিত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়ার পরিবর্তন আনতে হতে পারে। বেশির ভাগ দেশেরই তাদের বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য নিজস্ব প্রশাসনিক নিয়ম থাকে। এই পরিবর্তনগুলো যেকোনো ভাবে হতে পারে, যেমন- একত্রীকরণ, গ্রহন, ব্যবসায়িক পরিবর্তন ইত্যাদি। এই ধরনের পরিবর্তন এবং নতুন ব্যবসার শুরুর সিদ্ধান্ত এবং প্রতিযোগিতা করা বাংলাদেশের মত অনেক দেশেরই একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিছু কিছু উদ্যোক্তা এতই সৃষ্টিশীল যে তারা নতুন ব্যবসা শুরু করার ১-২ বছরের মধ্যে সাফল্য অর্জন করে এবং লাভজনক মূল্যে অন্য প্রতিষ্ঠানকে বিক্রি করে দেয়। এরপর সে নতুন ব্যবসা শুরু করে। এধরনের ব্যবসা অনেক দেশেই হচ্ছে। কৌশলী অংশীদারত্ব নতুন ব্যবসার সাফল্যের জন্য একটি সাধারণ সমস্যা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই সমস্যার সৃষ্টি হয় যেমন-পণ্য নামকরণ, বাজারজাতকরণ, নেটওয়ার্কিং ইত্যাদি। কিছু বড় প্রতিষ্ঠান নতুন চিন্তা ধারা প্রয়োগের জন্য সাহায্য করে। আর্থিক অবস্থা কোন সমস্যা নয় কিন্তু বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ উদ্যোক্তাদের এ ধরনের সুবিধা দিতে ইচ্ছুক নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করা সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য। ক্ষমতাসীনদের প্রভাব ও প্রযুক্তিগত অসুবিধার জন্য নতুন উদ্যোক্তাদের দীর্ঘ অপেক্ষা তাদেরকে নিরুৎসাহিত করে। অনুকূল পরিবেশ এবং কর্মসূচীর অভাবে আমরা বেশিরভাগ পণ্য স্থানীয় বাজারেই সীমাবদ্ধ রাখি। পণ্যের নামকরন আর্ন্তজাতিক বাজারের প্রবেশের একটি উপাদান। প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের পণ্যকে বিশ্ববাজারে পরিচিত করার জন্য চেষ্টা করে এবং এভাবে পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। প্রাণ, স্কয়ার ইত্যাদি পণ্য এক্ষেত্রে উদাহরণ। আমাদের স্থানীয়ভাবে কাজ করতে হবে এবং বিশ্ববাজারের জন্য ভাবতে হবে। আমাদের দেশে অনেক সফল প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু তারা "চেইন শপ" এর মাধ্যমে পণ্যের বাজারজাতকরণের চেষ্টা করছে না। আমাদের দেশে চেইন শপ শুরু করার যথেষ্ট সামর্থ্য এবং সম্ভাবনা রয়েছে। ধীরগতিতে হলেও কিছু প্রতিষ্ঠান কিছু সফল উদ্যোক্তাদের পুরস্কৃত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। অনেক উদ্যোক্তা রয়েছেন যারা সঠিক সময়ে সঠিক সাহায্যের অভাবে সফল হতে পারেন না। তরুণদের লক্ষ্য থাকে ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নের উপযুক্ত নির্দেশনা তারা পায়না। ফলে তারা হতাশাগ্রস্থ হয়ে যায়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন হওয়া প্রয়োজন যেখানে পড়াশোনা শেষ করার পর একজন শিক্ষার্থী পছন্দ অনুযায়ী তার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারবে। আমাদের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা এমন হওয়া প্রয়োজন যেখানে তরুণেরা তার লক্ষ্য নির্ধারণ করবে এবং বলবে- "আমার জীবনের লক্ষ্য একজন উদ্যোক্তা হওয়া", তারা তখন বলবে চাকুরী সুযোগ সৃষ্টির কথা, চাকুরী খোজার কথা নয়। শিল্প সংক্রান্ত উদ্যোক্তাদের আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এগিয়ে আসা উচিৎ। কারন পৃথিবীর বেশিরভাগ সৃষ্টিশীল কর্মকান্ড শিক্ষানীতি ফলেই সৃষ্টি হয় এবং বৃহৎ আর্থিক সুবিধাসমূহ শিল্প-বাণিজ্য থেকে আসে। তাই শিক্ষানীতি, বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিল্পপতি সবাই একত্রে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারে। এমনটি হলে আমাদের জাতি বিশ্ববাজারে প্রবেশ করতে পারবে এবং আমাদের উদ্যোক্তারা সৃষ্টিশীলতার প্রতিফলন ঘটাবে এবং অন্যদের জন্য চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করতে পারবে। আমাদের শিক্ষিত প্রথম প্রজন্মের তরুণেরা ঝুঁকি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক কিন্তু তারা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় এবং অনুৎসাহিত হয়ে পড়ে। তারা সঠিক অভিভাবক এবং সাহায্যের অভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। তারা আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন হয়। আমার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে এই বই এ উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করার চেষ্টা করেছি। আমি আশা করি বাংলায় “উদ্যোক্তা উন্নয়ন এর নির্দেশিকা” পাঠ করে নতুন উদ্যোক্তারা বহুমুখী সুবিধা পাবে এবং এই প্রয়াস ভবিষ্যতেও তাদেরকে সাহায্য করবে। বইটির মানোনন্বয়ে যে কোন পরামর্শ ও নির্দেশনা গৃহীত হবে।
বইয়ের বিবরণ
- শিরোনাম উদ্যোক্তা উন্নয়ন নির্দেশিকা
- লেখক ড. মোঃ সবুর খান
- প্রকাশক ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রেস
- প্রকাশের সাল ২০১৪
- মুদ্রণ 1st
- বাঁধাই Paperback
- পৃষ্ঠা সংখ্যা ৭৩
- ভাষা বাংলা
আলোর উৎস কিংবা ডিভাইসের কারণে বইয়ের প্রকৃত রং কিংবা পরিধি ভিন্ন হতে পারে।