বইয়ের বিবরণ

 পথের পাঁচালী মুখ্যত শিশু অপুর বড়ো হয়ে ওঠার কাহিনি। যে পথ দিয়ে জীবনে সে অগ্রসর হয়েছে, যেসব মানুষের সংস্পর্শে সে এসেছে, তা সেই কাহিনির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর পটভূমিটি সুবিস্তৃত। পূর্বপুরুষ ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়ের উপাখ্যান যদিও দূর ইতিহাসের অঙ্গীভূত, কৌলীন্যপথার অমানবিক যন্ত্রে পিষ্ট ইন্দির ঠাকরুণের জীবনের ইতিহাস অত সুদূরের নয়। ইন্দির ঠাকরুণের প্রতি সর্বজয়ার আচরণ সবসময়ে মানবিক নয়। যে-মা দূর্গা ও অপুর জীবনে উঁচু আসনে প্রতিষ্ঠিত, পিসির প্রতি তার রূঢ় ববহার তাদের জীবনের প্রাথমিক অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। উপন্যাসের পরবর্তী অংশ অপু-দূর্গা ও অপুর-দুর্গার শৈশবকাহিনি- সে কাহিনি অভিনবত্বে অসাধারণ নয়, কিন্তু মাধুর্যে পরিপূর্ণ। তারা দুজনেই গ্রাম্য প্রকৃতিকে ভালোবাসে, রেলপথ তাদের কাছে এক রহস্যজগতের বার্তা পৌঁছে দেয়। নতুন নতুন অভিযানে দুর্গা অপুর পথপ্রদর্শক, তবে অপুর মধ্যে অনুভূতির যে প্রখরতা এবং ভাবুকতার যে দোলা লক্ষ করা যায়, দূর্গার মধ্যে আমরা তা দেখি না। তবু চরিত্র হিসেবে এরা কেউই আদর্শায়িত নয়, প্রলুব্ধ দুর্গা চুরি করতেও কুণ্ঠিত হয় না- সে চুরির চিহ্ন মুছে দিতে অপু পরে তৎপর হয়, ততদিনে অবশ্য দুর্গা আর নেই। দুর্গার মৃত্যু অপুর জীবনে বড়োরকম আঘাত হানে, তার অভ্যস্ততায় ছেদ টানে , কিন্তু তা অপুর স্বাধীন বিকাশ ও সৃষ্টিশীলতার পথও উন্মুক্ত করে দেয়। এরপর কাহিনি একান্তই অপুর।

 জীবন ও প্রকৃতিকে অপু অবলোকন করেছে অপরিসীম বিস্ময় ও গভীর মুগ্ধতার সঙ্গে । অপুর দুই পা বাস্তব পৃথিবীতে প্রোথিত, কিন্তু তার দু-চোখে রোমান্‌সের অঞ্জন। স্বভাবসিদ্ধ কল্পনাপ্রবণতা ও তীক্ষ্ণ সৌন্দর্যনুভূতির গুণে সে মানুষের মধ্যে যে বিজন মহত্ত্ব অনুভব করে এবং প্রকৃতির মধ্যে যে ঐন্দ্রজালিক মোহনীয়তার সন্ধান পায়, অন্যের কাছে তা সহজে ধরা দেয় না। আমরা যে শ্রীহীন গ্রামকে জানি, যে দারিদ্রপীড়িত মানুষকে চিনি, যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে উদ্‌বিগ্ন হই, এখানে তার সবই অন্যরকম শ্রী, অন্যরকম শক্তি, অন্যরকম অবয়ব নিয়ে ধরা পড়ে। বস্তুর রূপকে ভেদ করে স্বরূপের উপলব্ধি অপুর দৃষ্টিভঙ্গির বড়োকথা। এই দৃষ্টিভঙ্গিসঞ্জাত বলে ঔপন্যাসিকের আত্মস্মৃতিমূলক এই উপন্যাস এমন মোহনীয় হয়ে উঠেছে। 

আলোর উৎস কিংবা ডিভাইসের কারণে বইয়ের প্রকৃত রং কিংবা পরিধি ভিন্ন হতে পারে।

আনিসুজ্জামান

জন্ম ১৯৩৭ সালে, কলকাতায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বি এ অনার্স, এম এ এবং পিএইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। গবেষণা করেছেন শিকাগো ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে, যুক্ত ছিলেন জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পে। শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্যারিস, নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন, বিশ্বভারতীতে ভিজিটিং প্রফেসর। সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কে ইংরেজি ও বাংলায় লিখিত ও সম্পাদিত তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা, কলকাতা, লন্ডন ও টোকিও থেকে। বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক পেয়েছেন; পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরোজিনী বসু পদক, এশিয়াটিক সোসাইটির পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্মারক ফলক ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মশতবার্ষিক স্মারক ফলক এবং রবীন্দ্রভারতীর সাম্মানিক ডি লিট্। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। মৃত্যু ১৪ মে ২০২০।

এই বিষয়ে আরও বই
আলোচনা ও রেটিং
০(০)
  • (০)
  • (০)
  • (০)
  • (০)
  • (০)
আলোচনা/মন্তব্য লিখুন :

আলোচনা/মন্তব্যের জন্য লগ ইন করুন