বইয়ের বিবরণ

অনেক সমালোচক রোহিণীর মৃত্যুর জন্যে ঔপন্যাসিকের নৈতিক বিবেচনাকে দায়ী করেছেন, কেউ কেউ এখানে নীতিবাদী বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে শিল্পী বঙ্কিমচন্দ্রের পরাজয় লক্ষ করেছেন। প্রেমের উপাখ্যান যদি সর্বদাই মিলনে শেষ হতো, তাহলে পৃথিবী থেকে ট্রাজেডি বিদায় নিতো। রোহিণীর মৃত্যু সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র নিজে যে-ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার প্রতি মনোযোগ দিলে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলতো: ‘যখন প্রসাদপুরে গোবিন্দলাল রোহিণীর সঙ্গীত¯্রােতে ভাসমান, তখনই ভ্রমর তাঁহার চিত্তে প্রবলতাপযুক্তা অধীশ্বরী-ভ্রমর অন্তরে, রোহিনী বাহিরে। তখন ভ্রমর অপ্রাপণীয়া রোহিণী অত্যাজ্যা,-তবু ভ্রমর অন্তরে রোহিণী বাহিরে। তাই রোহিণী অত শীঘ্র মরিল। যদি কেহ সে কথা না বুঝিয়া থাকেন, তবে বৃথায় এ অখ্যায়িকা লিখিলাম।’

গোবিন্দলাল রোহিণীকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়নি, কিন্তু তার কাছ থেকে শর্তহীন পাতিব্রত্য দাবি করেছিল। রোহিণীর সঙ্গে বাস করার সময়ে সে অপ্রাপণীয়া ভ্রমরকেই ফিরে পেতে চেয়েছে, যেমন করে একদিন ভ্রমরের সঙ্গে বাস করার সময়ে রেহিণীকে কামনা করেছিল। গোবিন্দলাল যা চেয়েছে, তার জন্যে কখনোই কোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকেনি।

প্রমথনাথ বিশীর মতো বিজ্ঞ সমালোচক রোহিণীর আচরণকে কুলটার অধম বলে গণ্য করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র কিন্তু বিধবা রোহিণীর জীবনের বঞ্চনা ও শূন্যতার জন্যে গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। প্রথম লিখনের পর কৃষ্ণকান্তের উইলে বঙ্কিমচন্দ্র যে রোহিণীর চরিত্রকে উন্নত করেছিলেন, তার তাৎপর্যও বিস্মৃত হওয়া ঠিক নয়। গোবিন্দলালের হাতে রোহিণীর অপঘাত মৃত্যুর পরে ঔপন্যাসিক রেহিণীর বর্ণনা দিয়েছেন ‘বালকনখরবিচ্ছিন্ন পদ্মিনীবৎ’ বলে। নিজের সৃষ্টির প্রতি যে-মমতা থেকে স্রষ্টা এ-কথা বলতে পেরেছিলেন, তার তাৎপর্য কেন সমালোচককে এড়িয়ে যাবে?

বঙ্কিমচন্দ্রের ইঙ্গিত অনুসরণ করে গোবিন্দলালকে বালক বলা যেতে পারে। এ-বালক যখন যা চায়, তখনই তাকে তা পেতে হয়। নইলে বিপদ। তার করণে রোহিণী মরে ভ্রমর মরে, আর সে আধ্যাত্মিক শাস্তি পেয়ে যায়। সুশীলকুমার দে যথার্থই প্রশ্ন করেছেন, এ কেমন বিচার?

সেকালের সমালোচকেরা ভ্রমরের অভিমানকে অনুচিত বিবেচনা করেছিলেন। তাঁদের মতে, ভ্রমরের উচিত ছিল স্বামীর সবকিছু মেনে নেওয়া। তা না করায়, একজন সমালোচকের ভাষায়, সতী শাড়ি ছেড়ে গাউন ধরলো। বঙ্কিমচন্দ্র ভ্রমরের মধ্যে যে-আত্মসম্মানবোধ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আরোপ করেছেন, তা-পাশ্চাত্যভাবাপন্ন হোক বা না হোক-চরিত্রটি মর্যাদাদান করেছে।

আলোর উৎস কিংবা ডিভাইসের কারণে বইয়ের প্রকৃত রং কিংবা পরিধি ভিন্ন হতে পারে।

আনিসুজ্জামান

জন্ম ১৯৩৭ সালে, কলকাতায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বি এ অনার্স, এম এ এবং পিএইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। গবেষণা করেছেন শিকাগো ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে, যুক্ত ছিলেন জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পে। শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্যারিস, নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন, বিশ্বভারতীতে ভিজিটিং প্রফেসর। সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কে ইংরেজি ও বাংলায় লিখিত ও সম্পাদিত তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা, কলকাতা, লন্ডন ও টোকিও থেকে। বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক পেয়েছেন; পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরোজিনী বসু পদক, এশিয়াটিক সোসাইটির পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্মারক ফলক ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মশতবার্ষিক স্মারক ফলক এবং রবীন্দ্রভারতীর সাম্মানিক ডি লিট্। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। মৃত্যু ১৪ মে ২০২০।

এই বিষয়ে আরও বই
আলোচনা ও রেটিং
০(০)
  • (০)
  • (০)
  • (০)
  • (০)
  • (০)
আলোচনা/মন্তব্য লিখুন :

আলোচনা/মন্তব্যের জন্য লগ ইন করুন