বইয়ের বিবরণ
- শিরোনাম কালো বরফ
- লেখক মাহমুদুল হক
- প্রকাশক সাহিত্য প্রকাশ
- আইএসবিএন ৯৮৪৭০১২৪০১১১৮
আলোর উৎস কিংবা ডিভাইসের কারণে বইয়ের প্রকৃত রং কিংবা পরিধি ভিন্ন হতে পারে।
আলোচনা/মন্তব্যের জন্য লগ ইন করুন
মো: ফাহাদ হোসেন ফাহিম
০২ Feb, ২০২৩ - ১২:৩৭ PM
বইয়ের পাতার কি আবার স্বাদ থাকে? কিংবা বরফের রঙ আবার কালো হয় কীভাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কৌতুহলী এই আমি মিশে গিয়েছিলাম "কালো বরফ" বইয়ের আলুনি স্বাদের শব্দচিত্রে, অথচ এক বুক রিক্ততা নিয়ে শেষ করতে হলো বইটি। টসটসে হিউমারের সাথে আছে সূক্ষ্ম জীবনবোধ। বইটির সংসর্গে এসে আমার হৃদয় আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল দেশভাগ, মনিদা, মা, টিপুভাই, ছবিদি, তুলি পাখি, মাধুরী, গিরিবালা, পোকা, আবদুল খালেক, রেখা; নির্বাপিত অন্য সবার গল্পও। হারিয়ে গিয়েছিলাম মাহমুদুল হকের ঘোরলাগা শব্দচিত্রের মিহি সৌকর্যে। বইটি শুরু করতেই মনে হচ্ছিল এ যেন মায়ের হাতে পিঠা খাচ্ছি। কি সুন্দর শব্দ বিন্যাস, সুললিত ভাষার সৌন্দর্য, হৃদয়কে চিরে দেখানোর উপযোগী শব্দচিত্র, ধ্বনির ইন্দ্রজাল সৃষ্টিতে নিপুণতা, প্রচন্ড সংক্রমণ শক্তিসম্পন্ন প্রকাশভঙ্গি! মনে মনে ভাবতে লাগি বাংলা সাহিত্যে এরকম উপন্যাসও বুঝি হয়! উপন্যাসের শুরুটা হয়েছে শৈশবের নিরাসক্ত স্মৃতিচারণা দিয়ে। পাচুর দেয়া কাঁচের চুড়ি নিয়ে প্রায়ই বিষম খেয়ে থাকতো পোকা। কারণটা ছিল আরও বেশি অদ্ভুত! হাবাগোবা ছেলেটি অনেকক্ষণ ধরে বসে দেখতো পুঁটির থালা বাসন মাজা, ধেঁড়ে মাছের সরের চাঁছি খাওয়ার আকুতি, আকন্দ ও শিমুলগাছের সাথে কথোপকথন। আহা, সে কি অনুভূতি! পুঁটির চিন্তা ভাবনা ছিল একটু অন্যরকম।হেড়েমাথার পোকাও ছিল বেঢপ ধরনের। মাথায় ঢু মারলেই শিং উঠার ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিতো সবসময়। চোখ ফুটে কান্না করার ভয়ে পুটির থেকে মন্ত্রও শিখেছিল ছেলেটা। বিনিময়ে পুঁটিকে দিয়েছিল ঔষধ মাড়ার খল। পুঁটি যখন মনের খেয়ালে পিচ্চি পোকাকে আজগুবি সব কথা বলছিল তখন বেশ মজা পাচ্ছিলাম। বুড়ো ঝাউগাছে সাহেবদের শকুন শিকার, সৈন্যদের সাথে ইংরেজি বলা, পানুর গান আর ইংরেজি- জিনজার মানে আদা, মিনজার মানে মাদা, গিনজার মানে গাঁজা। সত্যিই একবারে ডুবে গিয়েছিলাম উপন্যাসের সুমিষ্ট দিঘির জলে। একদিন ছবিদি কাঁদে, মনিদা চিরদিনের মত হারিয়ে যায়। সময়ের আবর্তনে পোকা হয়ে যায় নিরীহ অধ্যাপক আবদুল খালেক, আর সবাই লীন হয়ে যায় রেখাটুকুতে। এদিকে তরতর করে এগোতে থাকে গল্প আর আবদুল খালেক ওরফে পোকার দ্বৈত বয়ান দ্বন্দ্বে ফেলে দেয় আমাকে। দুজনকে মেলাতে পারি তখন, যখন গিরিবালা ঝুপ করে নেমে আসে আবদুল খালেকের ভাষ্যেঃ" বাইরে আকাশ বলে একটা কিছু আছে, তা জান তো! সেখানে একটা চাঁদ আছে, গোল চাঁদ। ঐ চাঁদের ভেতর হাঁটুমুড়ে কতোকাল বসে আছে। চরকায় সুতো কাটছে বসে বসে। " পোকা ও আবদুল খালেকের এই আজব যুগলবন্দি চলতে থাকে উপন্যাস জুড়ে। বাবা, মা, মনি ভাইজান, টিপু ভাইজান, রানিবুবু, পুঁটি, কেনারাম কাকা, ছবিদিরা পোকাকে অহর্নিশ সুখস্বপ্ন দেখিয়ে যায়, তার ছোট্ট জগতে তারা একেকজন অধীশ্বর হয়ে ওঠে, নিজেদের অজান্তেই। কিন্তু দেশভাগের টানাপোড়েনে সে বিচলিত হয়, তার ভেতরটা পুড়ে খাক হতে থাকে। কিন্তু আর দশটা মানুষের মত সবদিক সামলে চলার ব্যাপারে সে অপটুই থেকে যায়। রেখা ও আবদুল খালেকের ছোটখাট মান- অভিমানের ভেতর দিয়ে আবদুল খালেকের কল্পনাবিলাসী মন পাঠকের কাছে আরও গভীরভাবে ধরা দিতে থাকে এইভাবে- " রেখা আর টুকু, এই দুজনের জন্যে তার ভাবনা। নিজেকে সে বাদ দেয়; নিজেকে নিয়ে তার কোন সমস্যা নেই, কোনো না কোনোভাবে তার চলে যাবে।" উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশের শুরুটা হয় হঠাৎই "আলো ছায়ায় যুগলবন্দি" শিরোনামে। রেখা ও খালেকের টানাপোড়েন অনেকটা থিতিয়ে পড়ে এখানে, তারা সহসা আবিষ্কার করে, তাদের সম্পর্কের গাঁথুনি পলকা নয় মোটেই। কিন্তু চমকে উঠতে হয়, যখন হঠাৎ পাঠক আবিষ্কার করে, দেশভাগের সময় পোকার ঘরছাড়ার সেই স্মৃতি আবদুল খালেককে আজ পর্যন্ত বিবশ হয়ে তাড়া করে, আর কোন এক আলটপকা আচম্বিত মুহুর্তে ছাইচাপা আগুনের মত বেমক্কা জ্বলে ওঠে। পাঠক ধাক্কা খায়, যখন মনিভাইজান ছবিদির কাছ থেকে বিদায় নেয়। সেই যে সুর কেটে যায়, তাতে আবদুল খালেকের সারাটা জীবন বেসুরো হয়ে পড়ে। সম্পর্কের অতি পরিচিত কিন্তু অচেনা দিকগুলো যখন ব্যাপিত হওয়ার পরিবর্তে শীতল হয়ে জমতে শুরু করে তখন এর রঙ হালকা না হয়ে গাঢ় হয়ে যায়; বরফ সাদা না হয়ে কালো বরফ হয়ে নির্বাপিত হয়ে যায় গল্পের মতো করে। এভাবেই উপন্যাসের প্রতিটি শব্দ আমাকে স্পর্শ দিয়েছে কালো বরফের। সুবিখ্যাত ঔপন্যাসিক Harper Lee তার 'To Kill a Mockingbird' গ্রন্থে লিখেছিলেন, " You never really understand a person until you consider things from his point of view. " ১৯৪৭ সালে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা, বিদ্বেষ, ক্ষোভ, দেশভাগ, প্রেম, বিরহের সাথে কাহিনী, আখ্যান, সংলাপ ও মূল চরিত্রের বিষণ্ণ দর্শন , ছেলেবেলার স্মৃতিকথন আর চরিত্রদের মধ্যে সমসাময়িক আলাপচারিতার মাধ্যমে চরিত্রের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে সবকিছুর উপস্থাপনে মাহমুদুল হক সত্যিই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। "কালো বরফ" উপন্যাস তাই অনুভূতির একটি জীবন্ত দীর্ঘশ্বাস; বাংলা সাহিত্যের অনবদ্য এক শিল্প, যা একবার নয় বহুবার পড়া যায়, এবং প্রতিবারেই খুঁজে পাওয়া যায় নিত্যনতুন আনন্দ উপভোগ করার অনুষঙ্গ। লেখকের প্রিয় নিজামউদ্দিন ইউসুফকে উৎসর্গ করা ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে তার অনন্যতা, নিজস্বতার জন্য পাঠক নন্দিত হবে চিরকাল।