লোকগল্পের সারল্য আর আধুনিক গল্পবিশ্বের নিরীক্ষা মিলিয়ে শাহাদুজ্জামান তৈরি করেছেন এক স্বতন্ত্র গল্পভুবন। তাঁর গল্পে কখনো কখনো দেয়াল ভেঙে ঢুকে পড়ে কবিতা, প্রবন্ধ বা দর্শনের উপাদান। তাঁর গল্পভুবনে সাম্প্রতিক সংযোজন এই নতুন গল্পগ্রন্থ মামলার সাক্ষী ময়না পাখি। সমসময়ের গভীর উৎকণ্ঠা বয়ে গেছে প্রতিটি গল্পের শরীরে।
বইয়ের বিবরণ
শাহাদুজ্জামান এই বইয়ে এক স্তন্যপায়ী প্রাণীর কথা শুনিয়েছেন, যিনি গল্প লেখেন, শুনিয়েছেন এমন একজনের কথা, যাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অবস্থান খুব পরিষ্কার, কিংবা যাঁর হাতে টুকরো রোদের মতো খাম, জানিয়েছেন এক চিন্তাশীল প্রবীণ বানর, এক বোধিপ্রাপ্ত উবারচালক, অপস্রিয়মাণ তিরের দিকে তাকিয়ে থাকা এক যুগল আর ওয়ানওয়ে টিকিট হাতে এক বেকুবের কথা, সেই সঙ্গে শুনিয়েছেন এক বৃহস্পতিবারের গল্প, হরিণের মতো এক নারীর গল্প, যে লবঙ্গের বঙ্গ ফেলে দেয়, এক ময়না পাখির গল্প, যে মামলার সাক্ষী দেয়, সবশেষে মুখোমুখি করেছেন দুই নাজুক মানুষকে।
- শিরোনাম মামলার সাক্ষী ময়না পাখি
- লেখক শাহাদুজ্জামান
- প্রকাশক প্রথমা প্রকাশন
আলোর উৎস কিংবা ডিভাইসের কারণে বইয়ের প্রকৃত রং কিংবা পরিধি ভিন্ন হতে পারে।
শাহাদুজ্জামান
শাহাদুজ্জামানের জন্ম ১৯৬০ সালে ঢাকায়। পড়াশোনা মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। নেদারল্যান্ডসের আমস্টার্ডাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানে। পেশাগতভাবে তিনি চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্পে, পরে অধ্যাপনা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও অধ্যাপনায় যুক্ত আছেন। গল্প, উপন্যাস ছাড়াও প্রবন্ধ, অনুবাদ, ভ্রমণ ও গবেষণার ক্ষেত্রে রয়েছে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। মাওলা ব্রাদার্স আয়োজিত কথাসাহিত্যের পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ কয়েকটি বিহ্বল গল্প (১৯৯৬)। কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। Email : zshahaduz@gmail.com
আলোচনা/মন্তব্যের জন্য লগ ইন করুন
মো: নাফিউল ইসলাম
২৭ Feb, ২০২৩ - ৭:৪৭ PM
এ বইয়ে শাহাদুজ্জামান শুনিয়েছেন ছেলের মুখে বাবার গল্প যে বাবা নাকি মেকানিকাল ভেন্টিলেটরে, লাইফ সাপোর্টে। ডাক্তারের সাথে কথোপকথন, মাঝে টুকরো স্মৃতিচারণ, এ নিয়ে ' মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার' গল্পটি। শুনিয়েছেন স্তন্যপায়ী প্রাণী মতিনের গল্প যে 'মৃত্যু চিহ্নিত পৃথিবীর নিরেট দেয়ালে অলীক পৃথিবীর ছবি এঁকে এঁকে সবার বাঁচার আশাকে জাগরুক রেখে নিজের তৈরি মধুতে ডুবে একদিন মারা যায় '। আরেক গল্পে পাওয়া যাবে চিঠিযুগের মানুষ সোহেল মিয়া শাহীন মিয়ার গল্প যেখানে ফাঁসির আসামি চিঠি লিখে। বইটির নামগল্প 'মামলার সাক্ষী ময়না পাখি'তে লেখক বজলু ও মোমেনার গল্প, বিভৎস প্লাজা ফ্যাক্টরির ধ্বসের গল্প, ময়না পাখির মুখে।আবার পুরান ঢাকার গলির গল্প বুনেছেন শাহাদুজ্জামান 'চিন্তাশীল প্রবীণ বানর' গল্পে যেখানে এক প্রবীণ বানর চুরি করে কনডেন্সড মিল্ক।এ গল্পের চরিত্র আবুল মোমেন এক প্রশিক্ষণে বোস্টনে গিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায় ও পরে গ্রোসারি শপে চাকুরি নেয় এবং নারিন্দায় তার পরিবারের সদস্যরা অনিশ্চয়তায় পড়ে। অপ্রত্যাশিতভাবে গল্পটি শেষ হয় যেখানে শরীর সবকিছুর উপর জয়ী হয়। আরেক গল্পে মাসুদ নামের এক কমিউনিকেশন ডিভিশনের চাকুরের কাহিনি উঠে আসে যেখানে তার আইডিয়া চুরি করে কোম্পানির বড়কর্তার সুনজরে আসার চেষ্টা করে তারই আরেক সহকর্মী।গল্পটির নাম 'পৃথিবীতে হয়তো বৃহস্পতিবার '।টিনএজ মনের সাথে পরিবারের দ্বন্দ্ব এবং এক অপমৃত্যু উঠে আসে 'অপস্রিয়মাণ তির' গল্পে। 'উবার' গল্পে আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা, নেকাব পরা এক নারী আতঙ্ক সৃষ্টি করেন এক বিলাসবহুল হোটেলে। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের ভেতর লেখা এগারোটা গল্প এক মলাটের ভেতর এসেছে এই বইয়ে যার অনেকগুলোই আগে পত্রিকায় প্রকাশিত। শাহাদুজ্জামানের সমাজ পর্যবেক্ষণের একটা সুচারু রুপের প্রতিফলন মিলবে প্রতিটি গল্পে। এ যেন সমসাময়িক বাংলাদেশের গল্পই বলা হয়েছে নিপুণতায়। প্রতিটি গল্প পাঠককে মুগ্ধতায় ডুবিয়ে রাখবে তা কোনো সন্দেহ ছাড়াই বলা যায়। #প্রথমাডটকম_কথাপ্রকাশ_বই_রিভিউ_প্রতিযোগিতা
User
২৬ Feb, ২০২৩ - ১০:৪৯ PM
‘শেষ হয়েও হইল না শেষ!’ আমার পড়া কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের প্রথম বই এটি। আর প্রথম বইটিই যে আমাকে পুরোপুরি আকৃষ্ট করে ফেলবে, তা পড়ার আগ মুহুর্তেও কল্পনা করিনি। চমৎকার একটা গল্পগ্রন্থ। প্রতিটি গল্পই যেন আমাদের জীবনের খুব কাছের কোনো গল্প। হয়তো সেজন্যই নিজের জীবনের সাথে খুব বেশি তুলনা করতে পারছিলাম আমি। লেখকের বর্ণনাভঙ্গি এমন যে, মুগ্ধ না হয়ে থাকা অসম্ভব। মুগ্ধতার রেশ রয়েই যায় মস্তিষ্কে। কী দক্ষতার সহিত একেকটি গল্পের জন্ম দিয়েছেন লেখক শাহাদুজ্জামান! মনে হচ্ছিল, জীবনকে বুঝি তিনি খুব কাছ থেকে জেনেছেন। তাই জীবনের অতি চেনা গল্পগুলো তাঁর কলমের ডগায় উঠে এসেছে। ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ শাহাদুজ্জামানের এক স্বতন্ত্র গল্পগ্রন্থ। পাঠককে শুরুতেই থমকে দাঁড়াতে হয়েছে বইটির নাম দেখে। বইয়ের নাম দেখে বইটি পড়ার লোভ সামলানো বেশ কঠিন হয়ে পড়বে বুক লাভারদের জন্য। আমি যখন এই বইটির নাম প্রথম শুনি, কেবলই একটি বুদ্ধিদীপ্ত ময়না পাখিকে কল্পনা করছিলাম, যে কিনা শুধুমাত্র একটি সাক্ষী দিয়ে হয়তো বিরাট কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে! এক্ষেত্রে আমি বলবো, বইটির নাম চয়নে লেখক অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। সর্বমোট ১১টি বিবেক জাগ্রত গল্প নিয়ে রচিত এই গ্রন্থটি। প্রতিটি গল্পের মধ্যে রয়েছে গভীর উৎকণ্ঠা। প্রতিটি ক্ষুদ্র গল্প যেন আরও সূক্ষ্মভাবে হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। ১১টি গল্পের ৪টি গল্প অবশ্য পূর্বে প্রকাশিত হয়েছে এবং বাকি ৭টি পুরোপুরি নতুন। গল্পগুলোতে উঠে এসেছে অনুসন্ধিৎসা মন, সৃজনশীলতা, সহজে চোখে পড়ে না এমন শখের বাহার, নিজস্ব পরিচয় সৃষ্টির তাগিদ সহ বেশকিছু ইন্টারেস্টিং বিষয়। তাছাড়া ৪টি গল্পে দেখানো হয়েছে যৌনতা মানুষের যাপিত জীবনে কত বড় এক প্রভাবক! বইয়ের গল্পগুলোর বিষয়বস্তু একদমই মৌলিক এবং বাস্তবতা কেন্দ্রিক। আমার/আপনার চারপাশের ঘটা গতানুগতিক, বাস্তবধর্মী ঘটনাই প্রেক্ষাপট হিসেবে লেখক অত্যন্ত সুনিপুণভাবে বর্ণনা করে গিয়েছেন প্রতিটা গল্পে। সমাজের মানুষের চোখে অদৃশ্য ঘটনাগুলোকে লেখক আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন পাঠকদের। তাদেরকে উপলব্ধি করিয়েছেন সমাজের অপ্রিয় সত্য ঘটনাপ্রবাহ। বইয়ের ১১টি গল্পই অসাধারণ ছিল। তবে বিশেষভাবে ‘মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান পরিষ্কার’, ‘উবার’, ‘ওয়ানওয়ে টিকিট’, ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’— এ চারটি গল্প আমার মনে দাগ কেটেছে। সেগুলো সম্পর্কে হালকা ধারণা দিতে চাই আপনাদের ★ মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান পরিষ্কার : গল্পকথক লাইফ সার্পোটে বেঁচে থাকা পিতার বেগুন পোড়া চামড়ার উপর হাত বুলিয়ে ভাবেন, বাংলাদেশের সোনালী আঁশ স্বর্ণকেশী রূপকথার রাজকন্যা পাটের ইতিহাস, ভাবেন গ্রিক দেবী ইয়োস আর মানব টিথোনাসের অমর প্রেমকাব্য। ★ উবার : দাম্পত্য জীবনে স্বামীর উপর অনাস্থায় নজরদারি চালায় এক নারী। নজরদারির ঘটনাটি গোপণ রাখতে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণের জন্য সম্পূর্ণ থমথমে এক পরিবেশের সৃষ্টি হয় ফাইভ স্টার হোটেল। ★ ওয়ানওয়ে টিকিট : অতি চালাক হবার সুবাদে শ্বশুড়ের মনের মতো জামাই বনে যায় রফিকুল ইসলাম। অপরদিকে সবসময় রিটার্ন টিকেট নিয়ে আমেরিকা যাত্রা করা রফিকুল আলম সরল জীবনের চরম শিক্ষা পেয়ে এবার ওয়ানওয়ে টিকেট নিয়ে যাত্রা করেছে আমেরিকার পথে। ★ মামলার সাক্ষী ময়না পাখি : জীবনভর গাছের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা এক গাছির জীবনের রেখা পরিবর্তনের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে এই গল্পে। বইয়ের বিভিন্ন গল্পের আলোচ্য বিষয়ের সাথে বিদেশি সাহিত্য, গ্রাম্য কিংবদন্তি ইত্যাদি উপাদান লেখক অত্যন্ত যত্নের সাথে ব্যবহার করেছেন, যা পাঠককে গল্পের আরো গভীরে নিয়ে যাবে৷ পাঠক পড়তে পড়তে হারিয়ে গিয়ে বলে উঠবে— এ গল্পই তো আমার জীবন! ‘ওয়ানওয়ে টিকিট’ গল্পে প্রবাসী রফিকুল আলমের সেই উদ্ধৃতি যে কাউকেই রোমাঞ্চের স্বাদ পাইয়ে দিতে সক্ষম! ❝.....আমার বউ আর আমি একদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন আমার চোখে কী যেন একটা ময়লা পড়ল, তো আমার বউ আমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে ওর আঁচলের ডগাটা সরু করে পেঁচিয়ে চোখ থেকে ময়লাটা বের করে দিল। তো আমেরিকার এই বিখ্যাত শহরের বাতাসে তো ধুলা-ময়লাও নাই। ফলে এখানে আমার চোখে ধুলা পড়ার উপায় নাই। আর আমার বউ ওইখানে শাড়িও পড়ে না। সুতরাং ওই যে ওর আঁচল দিয়ে বউ আমার চোখের ময়লা পরিষ্কার করে দিল, এই চমৎকার দৃশ্য আমেরিকার এই শহরে তৈরি হওয়ার তো কোনো সুযোগ নাই।❞ শাহাদুজ্জামানের গল্পগুলো একটার পর একটা পড়ে শেষ করছি আর রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত চিরায়ত কথাটি মনে মনে আওড়াচ্ছিলাম—‘শেষ হয়েও হইল না শেষ!’ ছোটগল্পের অতৃপ্তিদায়ক সমাপ্তি যেন লেখক শাহাদুজ্জামানের লেখনীর স্বাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে! (২) বই:- মামলার সাক্ষী ময়না পাখি লেখক:- শাহাদুজ্জামান জনরা:- সমকালীন গল্প প্রকাশনা:- Prothoma ব্যক্তিগত রেটিং:-[৯/১০] ~রিভিউদাতা- হিমাদ্রি শর্মা #প্রথমাডটকম_কথাপ্রকাশ_বই_রিভিউ_প্রতিযোগিতা পড়তে আপনাকে হবেই, হয় বই নয়তো পিছিয়ে!🌻