বইয়ের বিবরণ
- শিরোনাম হেমলকের নিমন্ত্রণ
- লেখক সুজন দেবনাথ
- প্রকাশক অন্বেষা প্রকাশন
- আইএসবিএন সুজন দেবনাথ
- প্রকাশের সাল ২০২১
- মুদ্রণ Revised Edition
- বাঁধাই Hard Cover
- পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৫২
- দেশ Bangladesh
- ভাষা BANGLA
আলোর উৎস কিংবা ডিভাইসের কারণে বইয়ের প্রকৃত রং কিংবা পরিধি ভিন্ন হতে পারে।
আলোচনা/মন্তব্যের জন্য লগ ইন করুন
WASIM HOSSAIN
১৭ Sep, ২০২১ - ৩:৫৯ PM
জ্ঞানের রাজ্য গ্রিস (গ্রিক)। যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, হিরোডোটাস, পেরিক্লিসরা, পিথাগোরাসসহ জ্ঞান বিজ্ঞানের অসংখ্য শাখার বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিকিৎসক ও নাট্যকার। সেই জ্ঞানের রাজ্য থেকে বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক ও সাহিত্যিক সুজন দেবনাথের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ”। জ্ঞান বিজ্ঞান ও সাহিত্যের অসংখ্য শাখার মুল্যবান বিষয় সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় পাঠককে নিয়ে যাবে সেই সময়ের গ্রীসে! যে সময় সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, হিরোডোটাস, পেরিক্লিসরা সহ অসংখ্য আলোর সন্ধান দেওয়া আলোকিত মানুষের হাত ধরে অসংখ্য আলোর পথের সুচনা হয়েছে। আশাকরি বইটি প্রতিটি পাঠকের পঠিত শ্রেষ্ঠ উপন্যাস এর তালিকায় স্থান পাবে।
G F rabbi
১৭ Sep, ২০২১ - ৩:১১ PM
হেমলকের নিমন্ত্রণঃ একুশ শতকের চোখে ক্ল্যাসিক্যাল এথেন্সঃ প্রেম ও জ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা ।। গাজী নিষাদ চলমান শতাব্দীতে “হেমলকের নিমন্ত্রণ” আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এক নতুন সংযোজন যা পশ্চিম ও প্রাচ্যের সম্পর্কের ধারার মাঝে আরও এক নতুন পথ খুলে দিয়েছে। এটাকে বলা যেতে পারে পশ্চিম ও প্রাচ্যের মধ্যকার সচেতন জীবনবোধ ও ডিওটেমিক মিলনের ফসল। যেই ফসলের পিতা ও বাহক একজন বিশ্বভ্রামক বাঙালী কবি। গবেষক, গল্পকার, উপন্যাসিক, কবি, ও কূটনীতিক সুজন দেবনাথ, তাঁর এথেন্সবাসের অভিজ্ঞতা ও সূক্ষ্ম আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির এক অন্যতম নিদর্শন উপন্যাস ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’। ২০২০ সালে বইটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের অন্বেষা প্রকাশন। এথেন্সের সক্রেটিস কমিউনিটি নামে একটি ফোরাম বইটিকে সক্রেটিস বিষয়ক সাহিত্যের ( Socratic literature) এক অনন্য সংযোজন হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সক্রেটিসের জন্মদিন উপলক্ষে ২০২০ সালের জুনে এথেন্সে সক্রেটিস কমিউনিটি দ্বারা একটি অনলাইন প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়েছিল যেখানে মিঃ সুজন দেবনাথকে তাঁর বই ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’ উপস্থাপনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই ফোরাম গ্রীক পাঠকদের জন্য এই বইটিকে‘Η ΓΕΥΣΗ ΤΟΥ ΚΩΝΕΙΟΥ’ শিরোনামে গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করার প্রস্তাব করে । ২০২১ সালে এই ফোরাম ‘সক্রেটিস এবং শাস্ত্রীয় এথেন্সের সাহিত্যে’ অবদানের জন্যে মিঃ দেবনাথকে ‘সক্রেটিস কমিউনিটি অ্যাওয়ার্ড’ নামে একটি বিশেষ পুরষ্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গল্পটি নিয়ে সক্রেটিস কমিউনিটির ড. প্রোমাকস সুবাক্কাস মন্তব্য করেন- Undoubtedly, this is a unique and wonderful addition to the world literature on Socrates. This crispy and vivid story connects all the great men of the Greek Classical Time in a brilliant way. লেখক প্রথমে গল্পের প্লটকে কলার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে গল্প বা উপন্যাসের মাধ্যমকে বেছে নেওয়ার পেছনে যুক্তি দিয়েছেন। তাঁর মতে, মানুষ গল্পজীবী প্রাণী। “মানুষের জীবন একটা গল্প। মানুষ প্রতি মুহূর্তে গল্প বানায়। প্রয়োজনে বানায়, এমনি এমনিও বানায়। মানুষ গল্প শুনতেও ভালোবাসে। মানুষ গল্পভুক। মানুষের মস্তিষ্ক এমনভাবে তৈরি যে মানুষ কোনো বিষয়ের শুধু গল্পটুকু মনে রাখে। বাকি সবকিছু ভুলে যায়।” তাই ইতিহাসের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল সময়কে আঁকার জন্যে তিনি গল্পকে বেছে নিয়েছেন। [ টীকা- লেখকের যুক্তির সাথে সংযোজিত মতামত– গল্প নিজে এমন একটা ল্যান্ডস্কেপ যা গল্পের মাধ্যমেই নিজের সঠিক জায়গাটুকু খুঁজে পায়, সংগীত, কাব্য বা চিত্রকলায় নয়। আরও ব্যাপকভাবে পার্থক্য করলে- “গদ্য হলো বাস্তব আর কবিতা নাটক। যেমন, গদ্য হলো একটা unrefined আইডেন্টিটি (যেমন কোনো ব্যক্তির পার্সোনালিটি, যা সবসময় চোখে পড়ে), কবিতা হলো সেই ব্যক্তির হঠাত কোনো পার্টিতে যাওয়া সাজের মতো যা অনেকটা refined. গদ্যের নিজস্ব পরিপাটি অবস্থান আছে, আবার কবিতা নিজেকে কড়া মেকাপে আচ্ছাদিত করলেও তার ভিতরটা কাননবালার হৃদয়ের মতো tragic. কখনো গদ্য কবিতা ও কবিতা গদ্য হয়ে উঠে তখন কিছুটা এই বিষয়গুলি ভেঙে যায়৷ গদ্য চ্যালেঞ্জিং, কবিতাকে চ্যালেঞ্জ করা যায়না।” ] বইয়ের ভূমিকায় মূল গল্পের সাথে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবার পর্বে লেখক গ্রীস ও এথেন্স বিষয়ে তাঁর বিগত অনুরাগ ও অনুসন্ধানের কথা স্মৃতিচারণ করেন। কীভাবে তিনি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই গ্রীস ও এথেন্সের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন এবং প্রাচীন গ্রীক সমাজের বৃহত্তর জ্ঞানতৃষা ও মনীষীদের কথা জেনেছিলেন। এপর্যায়ে পুরো বইটির সাথে লেখক আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন এভাবে- “সেই সময় যখন ইউরোপের সভ্যতা ছিল আঁতুড়ঘরে। আঁতুড়ঘরের নাম এথেন্স। এথেন্স শহরে মাত্র দুটি প্রজন্মে জন্ম নিয়েছিলো বিজ্ঞান, ইতিহাস, গণতন্ত্র, সাহিত্যের ট্রাজেডি ও কমেডি, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, স্থাপত্য, নৈতিকতাসহ জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রায় সব শাখা। সেই জন্মের গল্পই ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’।” আর গল্পের সূত্রপাতের গল্পে লেখক বলেন- “সময়টি ছিল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও চতুর্থ শতক। এসময় এথেন্স এবং আশপাশের কটি শহরে জন্ম হয়েছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখা। একটি সময়ে একটি শহরে বুদ্ধিবৃত্তির এরকম সমাবেশ পৃথিবীর ইতিহাসে আর হয়নি। সেই সময়ের প্রায় আড়াই হাজার বছর পরে আমি চাকরি করতে আসলাম এথেন্সে। মাত্র এয়ারপোর্টে নেমেছি। আমার স্ত্রী নিবেদিতা বলল, ‘আচ্ছা, এখানে হেমলক কোথায় খায়?’ প্রশ্ন শুনে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হেমলকের মতো মারাত্মক বিষ খেতে হবে নাকি! ভয়ে ভয়ে নানান প্রশ্ন করে বুঝলাম, ‘হেমলক কোথায় খায়’ মানে হলো সক্রেটিস কোন জায়গায় হেমলক পান করেছিলেন? তো খুঁজতে শুরু করলাম সক্রেটিসের হেমলক পানের জায়গাটি। সেই খোঁজ থেকেই এই বইয়ের শুরু।” সুজন দেবনাথ উপন্যাসটি রচনা করেছেন তিনটা প্রাথমিক অনুসন্ধানকে ঘিরে। “আমার অনুসন্ধান ছিল মোটামুটি তিনভাবে। সেই সময়টিকে পড়ে ফেলা, তারপর নিজের চোখে ঘটনার জায়গাগুলো দেখা, এরপর জটিলতা থাকলে কোনো গ্রিক বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলা। এই অনুসন্ধান থেকেই ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’। গল্পের পটভূমি খ্রিস্টের জন্মের আগের পঞ্চম শতক। বছর হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব ৫১০ থেকে ৩৯৯ অব্দ পর্যন্ত। গণতন্ত্রের জন্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫০৮ আর সক্রেটিসের মৃত্যু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও চতুর্থ শতককে পণ্ডিতগণ বলেন গ্রিসের ক্লাসিক্যাল সময়। আমি এ সময়টাকে ধরতে চেয়েছি।” পরিসর বৃহৎ হলেও গল্পের টাইমলাইন স্পষ্ট। এবার ২০২১ শতকে দাঁড়িয়ে লেখক উপস্থাপন করেছেন খ্রীস্টপূর্ব ৫১০ থেকে ৩৯৯ অব্দকে গল্পে নিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে তাঁর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা। “অনুভব করতে চেয়েছি সক্রেটিস কিভাবে এথেন্সের আগোরার পথে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কঠিন দর্শনের কথা সহজ করে বলতেন। কারা কোন আদালতে ঠিক কিভাবে বিচারের নামে হত্যা করলো সক্রেটিসকে। হেরোডটাস কোথায় বসে কোন অবস্থায় লেখা শুরু করলেন পৃথিবীর প্রথম ‘ইতিহাস’। গণতন্ত্রের মতো একটি অভিনব ব্যবস্থা কোন মানুষগুলো কিভাবে আবিষ্কার করলো। চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিপোক্রাটিস ঠিক কোন সময় ডাক্তারদের জন্য লিখলেন তার চমৎকার ‘হিপোক্রাটিক শপথ’। পৃথিবীর সমস্ত সাহিত্যের কাঠামো গ্রিক ট্রাজেডি আর কমেডি। এই গল্পে আমি দেখতে চেয়েছি সেই থিয়েটার, যেখানে গ্রিক ট্রাজেডি জন্ম নিয়েছিল। কথা বলতে চেয়েছি পৃথিবীর প্রথম অভিনয়শিল্পীদের সাথে। ঢুকতে চেয়েছি হোমারের অন্ধ কুঠুরিতে, সফোক্লিসের নাটক লেখার মনে, ইউরিপিডিসের ট্রাজিডির গুহায়। আমি তাদের লেখাকে তাদের মতো করে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছি।” লেখকের এই বক্তব্যকে এখানে যেরকম ভাবসিদ্ধ ও কল্পনামিশ্রিত অভিজ্ঞতার অনুভব মনে হয়, পরক্ষণেই তার পরের কথাগুলি প্রমাণ করে, তার চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার তুলি কতোটা সূক্ষ্ম ও বাস্তব। একইসাথে তথ্যবহুল। কারণ বইটির শিরোনাম “হেমলকের নিমন্ত্রণ” হলেও তাঁর গল্পের সীমা হেমলক ও সক্রেটিসের জীবন পেরিয়ে আরও দূরে বিস্তৃত, যেখানে এসেছে তৎকালীন এথেন্সের মানুষের জীবনাচার- বিশ্বাস- সংস্কৃতি, পরিবেশ, ও সমাজব্যবস্থা । একইসাথে এই সময়কালের আলোচিত প্রতিপাদ্য, এর বহুপ্রকাশিত জ্ঞানকলা যা বহু ব্যক্তি মনীষীর বিপুল ও সার্থক আগমনে যুগপৎভাবে পুষ্ট। তবে নিঃসন্দেহে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সক্রেটিস ও সক্রেটিসের জীবন, বলা যায়, তাকে ঘিরেই এই গল্প আবর্তিত হয়েছে। আর গল্পের ভূগোল ক্ল্যাসিক্যাল এথেন্স। traditional এথেন্স যেই সময়কালে এক নতুন যুগস্রষ্টির সম্ভাবনায় উজ্জীবিত ও আলোকিত। যেই যুগসন্ধি এথেন্সকে সভ্যতার এক পরিণত ও অগ্রসর জাতিতে পরিণত করেছিলো। সুজন দেবনাথ সেই বিকশিত মহাসমারোহকে তার উপন্যাসে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন। লেখকের ভাষায়- “খ্রিস্ট পূর্ব ৪৭২ অব্দে ইউরোপের প্রথম ট্রাজেডি লিখেন এস্কিলাস। ট্রাজেডির নাম ‘Persia’ বা পারস্য’। মানুষ যতো সুখেই থাকুক না কেন, মানুষের অন্তরে চিরকালের একটা দুঃখ-কোঠা আছে, মানুষ নিজের অজান্তেই নিজের হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগায়। তাই বেদনার সাহিত্যই মানুষের মনে গভীরভাবে থেকে যায়। সেজন্য আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কালজয়ী সাহিত্যের প্রায় সবই আসলে ট্রাজেডি। সেই ট্রাজেডি কিভাবে লেখা শুরু করলেন এস্কিলাস, কি ছিলো তার প্রেক্ষাপট, সেগুলোই গল্পের মধ্যে নিয়ে এসেছি। এরিস্টটলের মতে, পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ট্রাজেডি সফোক্লিসের ‘রাজা ইদিপাস’। রাজা ইদিপাসের কাহিনী পড়েছে আর ধাক্কা লাগেনি, এমন মানুষ পৃথিবীতে নেই। আমি মানতেই পারতাম না নিজের মাকে বিয়ে করে ফেলার মতো নির্মম আর ভয়াবহ কাহিনী সফোক্লিসের মতো একজন বিশাল লেখক কেন লিখলেন! সেই প্রশ্নটি আমার একেবারে ছোট্টকালের। এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে কেউ দিতে পারেনি। এই গল্পে আমি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি। আমি দেখতে চেয়েছি, ঠিক কখন সফোক্লিস উচ্চারণ করলেন, ‘আমি পৃথিবীতে এসেছি শুধুই ভালোবাসার জন্য, কখনই ঘৃণা করার জন্য নয়।’ প্লেটো ছিলেন একজন কবি। সক্রেটিসের ছোঁয়ায় সেই কবি প্লেটো কবিতা ছুড়ে ফেলে হয়ে গেলেন কঠিন নির্দয় দার্শনিক। তার কল্পনার আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবি সাহিত্যিকদের দিলেন নির্বাসন। প্লেটোর কবি থেকে দার্শনিকে বিবর্তন পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসকেই বদলে দিয়েছে। প্লেটো দর্শন না লিখলে পৃথিবীই হতো অন্যরকম। প্লেটোর এই পরিবর্তনকে আমি খুঁজতে চেয়েছি। ইউরোপে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের বদলে যাওয়া দেখতে চেয়েছি। কিভাবে মিশরের অনুভূতিহীন ভাস্কর্য বদলে গিয়ে মানুষের মতো হলো, ঠিক কখন পাথরগুলো হাত পা বাঁকা করে আড়চোখে তাকাতে শুরু করলো, সেটি খুঁজতে চেয়েছি।” লেখকের মতে, তাঁর উপন্যাসের কোনো চরিত্রই কল্পনাশ্রয়ী নয়৷ ইতিহাসের প্রতিটি বাস্তব চরিত্র থেকে এই গল্পের নির্যাস সংগ্রহ করেছেন। সেই সময়ের একঝাঁক সৃষ্টিশীল মানুষের জীবন ও সৃষ্টিকে তিনি একটা কাহিনীতে আনার চেষ্টা করেছেন, আর সেই কাহিনির মুখ্য চরিত্র সক্রেটিস ও তার জীবন। যার সাথে সমান্তরালভাবে এই গল্প তার পরিণতি খুঁজেছে। “দার্শনিক প্লেটো; ইতিহাসের জনক হেরোডটাস; ট্রাজেডি নাটকের তিন পিতাসফোক্লিস, ইউরিপিডিস ও এস্কিলাস; কমেডি নাটকের জনক এরিস্টোফানিস; চিকিৎশাস্ত্রের জনক হিপোক্রাটিস; এথেন্সের গণতন্ত্র ও জ্ঞানচর্চার প্রধান পৃষ্ঠপোষক পেরিক্লিস; নারী দার্শনিক আসপাশিয়া; স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের প্রধান শিল্পী ফিডিয়াস; সক্রেটিসের স্ত্রী জেনথিপি এবং তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু দার্শনিক ক্রিতো, চেরোফোন এবং সিমন। এছাড়া গল্পের ছায়ায় আছেন দার্শনিক পিথাগোরাস, বিজ্ঞানের জনক থেলিস এবং নগর পরিকল্পনা শাস্ত্রের জনক হিপোডেমাস।” সক্রেটিসের জীবন বিষয়ে লেখক তথ্যের ধোঁয়াশার কথা উল্লেখ করেছেন, কারণ সক্রেটিস নিজে কিছু লিখে যাননি বরং তাকে নিয়ে লিখেছেন প্লেটো, সক্রেটিসের ছাত্র জেনোফোন এবং নাট্যকার এরিস্টোফেনিস। আর এরমধ্যে নির্ভরযোগ্য প্লেটোর রচনাবলি। তিনি তার গল্পের বাস্তবতার বিষয়ে বলেন- ” পণ্ডিতেরা মনে করেন, প্লেটো তার কিছু বইয়ে সক্রেটিসের প্রকৃত জীবন কথা লিখেছেন আর বেশির ভাগ বইয়ে প্লেটোর নিজের ধারণা সক্রেটিসের মুখে সংলাপ হিসেবে বসিয়ে দিয়েছেন। তাই প্লেটোর লেখার কোনটি সক্রেটিসের কথা আর কোনটি প্লেটোর নিজের কথা, সেটি প্লেটো ছাড়া আর কেউ বলতে পারেন না। সেজন্য প্রকৃত সক্রেটিসকে কোনভাবেই নিশ্চিত করে জানা সম্ভব নয়। সক্রেটিস সব সময়ই একটি ধোঁয়াশা। সক্রেটিসকে নিয়ে এই ধোঁয়াশাকে পণ্ডিতগণ বলেন সক্রেটিস সমস্যা। এই সমস্যাকে মেনে নিয়েই আমি মানুষ সক্রেটিসকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। প্লেটোর রচনা ছাড়া হেরোডটাসের ইতিহাস, হোমারের ইলিয়াদ ও অডিসি, এরিস্টটলের রচনা এবং তখনকার নাট্যকারদের লেখা নাটকগুলোই সেই সময়কে বোঝার একমাত্র উপায়। এরপরে আড়াই হাজার বছর ধরে সেই সময়কে নিয়ে যারাই লিখেছেন, লেখকের নিজের কল্পনা মিশে গেছে তাদের লেখায়। সেখান থেকে শুদ্ধ কাহিনী বের করা অসম্ভব। তাই আমার কাহিনী একশভাগ শুদ্ধ বলে দাবি করবো না। তবে আমি জেনে বুঝে কোনো ভুল তথ্য দেইনি। আমি কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনকে বদলে দেইনি। একটিও কাল্পনিক চরিত্র নেইনি।” এখান থেকে এটা বুঝা যায় যে এই উপন্যাস শুধু নিছক একটি গল্প নয়, এটি ইতিহাসের এক অসামান্য দলিলও বটে। যার কথনরীতিটা গল্পের ফর্মে ও লেখকের কল্পনাশ্রয়ী হলেও যেই গল্প থেকে উঠে আসা ঘটনাগুলি তথ্যসূত্রে প্রমাণিত। যেমনভাবে কোনো ‘শব্দ’ সৃষ্টি হয়। আমরা প্রায়ই জানিনা আমাদের ব্যবহৃত শব্দগুলির আবিষ্কারক কারা, কিন্তু এটা আমরাই, যারা শব্দ তৈরি করে। ফলে শব্দ বা বক্তব্যকে যদি আমরা এই উপন্যাসে ব্যক্তিকে ছাপিয়ে দেখি তাহলেও সেই শব্দের/পদের আড়ালে এক হেমলকপায়ী ব্যক্তি সক্রেটিসেরই জীবন উঠে আসে, সেখানে আমরা পৌঁছুতে পারি আর না পারি। সুজন দেবনাথ আড়াই হাজার বছর আগের সেই ব্যক্তি সক্রেটিসকে খুঁজেছেন, যিনি শুধু একজন শিক্ষক ( বা তৎকালীন এথেন্সবাসীদের একাংশের কথায় তরুণদের বিপথে চালনাকারী), বা দার্শনিক নন, একজন সংবেদনশীল প্রেমিক, বন্ধু, বা সর্বোপরি একজন সাধারণ মানুষ, কোনো মনীষী নয়। লেখক সেই সময়কার এথেন্সের হৃদয় ও সেই হৃদয়ের রক্তপাতকে ছুঁতে চেয়েছেন। যার রক্তিম উৎস হলো ‘সক্রেটিস’। এরপর লেখক বেদনাভরে বলেন, “আমাকে যেটি কষ্ট দিয়েছে, সেটি হলো এথেন্সের এমন সৃষ্টিশীল সময়ে কোথাও মেয়েরা নেই। মেয়েদের প্রতি এমন অবিচার আর কোন যুগের মানুষ করেননি। আমার ধারণা মেয়েদের অংশ নিতে দেয়া হয়নি বলেই, এথেন্সের অবিশ্বাস্য সুন্দর যাত্রাটি মাত্র দুটি প্রজন্মেই শেষ হয়ে গেছে। এই বই লিখতে গিয়ে নারী চরিত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু নারী ছাড়া কি সাহিত্য হয়? অবশেষে অনেক খুঁজে দুজন নারীকে নিয়েছি। একজন সে সময়ের সবচেয়ে বিদুষী নারী দার্শনিক আসপাশিয়া, আরেকজন সক্রেটিসের স্ত্রী জেনথিপি। আসপাশিয়া এই বইয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। সেই নারীবিবর্জিত জ্ঞানীদের ভিড়ে শুধু নিজের বুদ্ধি দিয়ে সময়টিকে বাজিয়েছিলেন আসপাশিয়া। আর সক্রেটিসের স্ত্রী জেনথিপির বিষয়ে আমার মনে হয় প্লেটো থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সব লেখক তার ওপর অন্যায় করেছেন। প্লেটো সারা জীবনে এক লাখের বেশি শব্দ লিখেছেন, সবগুলোই সক্রেটিসকে নিয়ে, কিন্তু জেনথিপির কথা বলেছেন মাত্র দুইটি জায়গায়। সব লেখক জেনথিপি শুধুই একজন মুখরা নারী বলেছেন। কিন্তু আমার গল্পে তিনি শুধু মুখরা নারী নন; অভিমান ও প্রেমমাখা রক্ত-মাংসের একজন নারী যে ¯স্বামীকে তীব্রভাবে ভালোবাসে কিন্তু ¯স্বামীর অবহেলা সুদে-আসলে ফিরিয়ে দিতে সারাদিন বকাঝকা করে।” এখান থেকে তৎকালীন এথেন্সের নারীদের অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়, যেকারণে জ্ঞানকলায় এতো সমৃদ্ধি আসার পরেও এথেন্সের এই যুগটিকে এই দিক থেকে একপ্রকার অন্ধকারাচ্ছন্নই বলা চলে। কারণ নারীর বিকাশ ছাড়া একমাত্র পুরুষের বিকাশ দিয়ে কোনো যুগকাল পরিপূর্ণ হয়না। আর সেই যুগকালের অন্তর্মিলিত সুর মহানাদে বেজে উঠেনা। সুজন দেবনাথ গল্পে তার ব্যবহৃত শব্দের প্রবাহধারা নিয়ে মত দিয়েছেন, “ভাষার ব্যাপারে আমি এই বইয়ে অত্যন্ত সচেতনভাবে একুশ শতকের তরুণদের মুখের ভাষাটিকে প্রমিত ভাবে আনতে চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি সব যুগেই একটা প্রমিত মানদণ্ড রেখে সে যুগের মুখের ভাষাটিই সাহিত্যের ভাষা হয়ে ওঠে। এছাড়া আমার মনে হয়েছে সক্রেটিস সবসময় wit আর রসিকতা মিশিয়ে তরুণদের সাথে কথা বলতেন। সেজন্য এই বইয়ে আমি ইচ্ছে করেই এই সময়ের তরুণদের মুখের প্রাঞ্জল ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করেছি।” “হেমলকের নিমন্ত্রণ” বইটি লেখক এমনভাবে সাজিয়েছেন যে একজন পাঠক, এটিকে অনেকগুলি ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্রীয় গল্পের প্লট হিসেবে দেখতে পারেন। কেউ দেখতে পারেন ক্ল্যাসিক্যাল এথেন্সে জ্ঞানকলার বহুবিধ শাখার উৎপত্তির গল্প হিসেবে, প্রথম গণতন্ত্রের উত্থানের গল্প হিসেবে, তৎকালীন এথেন্স শহরের গল্প হিসেবে, একটা সমাজব্যবস্থার কাঠামোর পরিবর্তনের গল্প, সক্রেটিস-প্লেটো, পেরিক্লিস, আসপাশিয়া, ডিওটিমার মতো দার্শনিক, শিক্ষক, রাজনীতিকের, বা কয়েকজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের গল্প হিসেবে। বা নিছক শুধুই একটা গল্প হিসেবে। তবে যেভাবেই দেখা হোক না কেন, এর প্রতিটি ভিন্ন আঙ্গিকই একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তবে গল্পটির উল্লেখযোগ্য প্লট যে প্রেম তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। যেটা গল্পের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠক অনুভব করতে পারবেন। “”ছোট প্রেম সংসার গড়ে আর বড় প্রেম সংসার ভাঙে। বড় প্রেম বিরহের জন্য উপযোগী, সংসারের জন্য নয়। সংসার হলো দুটি মানুষের প্রতিদিনের ঝগড়া-ঝাটি, রাগ-ক্রোধ, অভিমান মিশানো একঘেয়ে অম্ল-মধুর জিনিস। তার জন্য দরকার সাধারণ, একঘেয়ে ছোট্ট প্রেম। বড় প্রেমে এগুলো খাপ খায় না। বড় প্রেম হলো হঠাৎ উচ্ছ্বাস, যা দুজনকে ভাসিয়ে নেয়, আশেপাশের মানুষকে নাড়িয়ে দেয়। এই প্রেম দিয়ে ভালো সাহিত্য হয়, কিন্তু ভালো সংসার হয় না। এই প্রেম দুটি জীবনকে পুড়িয়ে দেয়, প্রত্যাশার আগুনে জ্বালিয়ে দেয় সংসার। হেলেন আর প্যারিসের প্রেমে পুড়ে যায় ট্রয় নগর। বড় প্রেম কোন কিছুকে ধরে রাখে না, ধরে রাখে ছোট প্রেম। তাই অনেক আশা নিয়ে শুরু হওয়া বড় বড় প্রেমের সংসার সুখী হয় না, সুখী হয় ছোট প্রেমের সংসার। ছোট প্রেম নিজে ছোট বলে অন্যায় রাগ-ক্রোধকে জায়গা দিতে পারে, আর জায়গা দিতে দিতে ছোট প্রেমের ব্যক্তিত্ব বড় হয়ে ওঠে, সে সেক্রিফাইস করতে শিখে যায়। আর বড় প্রেম নিজে বড় বলে একটি ছোট্ট অভিমানকেও জায়গা দিতে পারে না, ছাড় না দিতে দিতে বড় প্রেমের ব্যক্তিত্ব ছোট হয়ে যায়, সেক্রিফাইস কি জিনিস সেটাই ভুলে যায়। তাই ছোট প্রেম সংসার গড়ে আর বড় প্রেম সংসার ভাঙে।” এভাবে গল্পের অগ্রগতির সাথে আমরা দার্শনিক সুজন দেবনাথেরও দেখা পাই, যেখানে গল্পের এক নিভৃত পর্যবেক্ষক হিসেবে তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার অনুসন্ধিৎসু চিন্তা ও গভীর দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ রেখে গেছেন। গল্পের স্থানগুলি এতো জীবন্তভাবে বর্ণিত হয়েছে যে চোখে গ্লাভস পরে সীটবেল্ট বেঁধে নিয়ে অনায়াসে একটা টাইম ট্রাভেল করা যায়। আড়াইহাজার বছর আগের এথেন্স নগরী। এথেন্সের আগোরা, সিমনের জুতার দোকান, আসপাশিয়া ও পেরিক্লিসের বাড়ি, শহরের একটা পাড়া এলোপেকি, আপনমনে রাস্তায় হেঁটে চলা সক্রেটিস। তার সাথে প্রিয় বন্ধু ক্রিতো। দূরে দেবী এথিনার মন্দির। আর এই পথ ধরেই একদিন হিমশীতল কারাকক্ষ, যেখানে সক্রেটিসের জন্যে অপেক্ষমাণ এক পেয়ালা হেমলক। আর সেইসাথে একটা যুগের সমাপ্তি এবং এক নতুন যুগের সূচনা। লেখকের অপরিসীম মনোযোগ, পরিশ্রম আর কাব্যিক স্পর্শ একটা বিপুল সময়ের ফ্রেমকে জীবন্ত করে তুলেছে পাঠকের সামনে। একইসাথে লেখক খোঁজ করেছে সক্রেটিস বিষয়ে বিজ্ঞ বর্তমান সময়ের দুর্লভ কয়েকজন ব্যক্তিকে( যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য এভমিখানোস মোসকোনাস , বর্তমান এথেন্সে যিনি সক্রেটিসের সময়ের ডায়ালেক্টে কথা বলতে পারা একমাত্র জীবিত মানুষ), তারসাথে খুঁজেছে সেই যুগকালের সাথে এই যুগকালের রেখাকে, সমসাময়িক বিশ্বনীতি ও নান্দনিকতাকে, সর্বোপরি যাকিছু জীবন ও সংসার থেকে উঠে আসে-তাকে। গাজী নিষাদ (গাজী ফজলে রাব্বি) শান্তিনিকেতন gazinishad7@gmail.com
User
১৬ Sep, ২০২১ - ৯:৩৭ PM
অসাধারণ একটি বই। অনেক তথ্যসমৃদ্ধ। ট্রাজেডি, বিজ্ঞান,গণতন্ত্র, দর্শন, চিকিৎসা শাস্ত্রের জন্মের ইতিহাস খুব সহজ সরলভাবে উপস্থাপন করেছেন।সবাইকে পড়ার জন্য রেকোমেন্ড করা হলো। ধন্যবাদ লেখকে এইরকম মাস্টারপিস একটি বই উপহার দেওয়ার জন্য
Aniket Rajesh
১৫ Sep, ২০২১ - ৩:৩৯ PM
"হেমলকের নিমন্ত্রণ" এককথায় অসাধারণ একটি উপন্যাস। এর পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় আমি শুধু বলব- আমি মুগ্ধ। বাংলাভাষায় এমন ধারার সাহিত্যকর্ম, এমন তথ্য ও জ্ঞানভিত্তিক উপন্যাস আরও হোক। লেখক সুজন দেবনাথের প্রতি অনুরোধ এটির পরবর্তী খণ্ডও যেন প্রকাশিত হয়।