শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বিষয়: প্রবন্ধ, গবেষণা ও অন্যান্য

৩০০.০০ টাকা ২৫% ছাড় ৪০০.০০ টাকা

বইয়ের বিবরণ

বাঙালী ও জাতীয়তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।  তাঁর লেখা বাঙালীর খোঁজে, বাঙালীকে কে বাঁচাবে, দ্বি-জাতিতত্ত্বের সত্যমিথ্যা বইয়ে বিষয়গুলোকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি।  রাজনীতি বিষয়ে গভীর মনস্তাত্ত্বিক মতামত আর ভাষা, সাহিত্য, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর আছে মৌলিক বিশ্লেষণ।  আমাদের ভাষা, রাষ্ট্র, স্বাধীনতা নিয়ে উল্লেখযোগ্য ভাষ্য রচনা করেছেন।  তরুণ সমাজে এগুলোর প্রভাব নিয়েও তাঁর বৈদগুপূর্ণ আলোচনা স্মর্তব্য।  তিনি একুশ বছরের প্রবন্ধ সাহিত্যের গতি-প্রকৃতিকেও বাদ দেননি তাঁর আলোচনা থেকে।  একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, ‘শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ’ গ্রন্থটি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ব্যক্তিত্ব ও চিন্তার বিশিষ্টতাকে উন্মোচন করতে বিশেষ সহায়ক হবে। 

আলোর উৎস কিংবা ডিভাইসের কারণে বইয়ের প্রকৃত রং কিংবা পরিধি ভিন্ন হতে পারে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

জন্ম ২৩ জুন ১৯৩৬, বিক্রমপুরের বাড়ৈখালী। শিক্ষাজীবন কেটেছে রাজশাহী, কলকাতা ও ঢাকায়; পরে ইংল্যান্ডের লিডস ও লেস্টারে। ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ২০০৮ সালে ইমেরিটাস প্রফেসর হিসেবে স্থায়ী হন। প্রধানত প্রবন্ধ লেখেন। গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, অনুবাদও করেছেন। বইয়ের সংখ্যা প্রায় এক শ। নিয়মিত সম্পাদনা করছেন ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত। ওসমানী উদ্যান, লালনের আখড়া এবং আড়িয়াল বিল রক্ষা আন্দোলনসহ অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

এই লেখকের আরও বই
এই বিষয়ে আরও বই
আলোচনা ও রেটিং
৫(১)
  • (১)
  • (০)
  • (০)
  • (০)
  • (০)
আলোচনা/মন্তব্য লিখুন :

আলোচনা/মন্তব্যের জন্য লগ ইন করুন

Kumar Deep

০১ Mar, ২০২৩ - ৭:২২ PM

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশের মননশীল প্রবন্ধসাহিত্যে সমীহজাগানিয়া একটি নাম। সৃজনশীল রচনা দিয়ে লেখক জীবন শুরু করা সিরাজুল ইসলামের দুটি গল্পের বই ও দুটি উপন্যাস থাকলেও অচিরেই তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন কথাসাহিত্য নয়, প্রবন্ধসাহিত্যই তাঁর প্রধান জগৎ। কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ’ বইটি কেবল লেখকের প্রধান গদ্যের সংকলনমাত্র নয়, বাংলাদেশের প্রবন্ধসাহিত্য জগতেরই একটি মূল্যবান সংযোজন। বইটিতে ২৬টি গদ্য রয়েছে, যেখানে নৃতত্ত¡-ইতিহাস-পুরাণ-দর্শন-সভ্যতা-সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিক্ষা-রাজনীতি-জাতি-জাতীয়তা-দেশপ্রেম ইত্যাকার বিষয়াদি অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখাপড়া ও জানাশোনার জগৎ অনেক বড়ো, স্মৃতিশক্তিও ঈর্ষাজাগানিয়া। কোনো একটি শিরোনামের গ্রন্থে যেমন একাধিক বিষয়ের গদ্য অন্তর্ভূক্ত করেন, তেমনি একই গদ্যের ভেতরে ঢুকিয়ে দেন একাধিক বিষয়াবলি। শুধু বাংলা বা ভারতবর্ষীয় নয়, প্রসঙ্গক্রমে তিনি প্রবেশ করেন বৈশ্বিক জ্ঞানের আঙিনায়; বিশ্বের ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন থেকে তুলে ধরেন বিবিধ উদাহরণ ও উদ্ধৃতি। খুব নিরীহ শিরোনামের একটি গদ্যের ভেতরেও পাঠক পেয়ে যান বিশেষ বিশেষ সব তথ্য ও তত্তে¡র দিশা। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হওয়ায় বিবিধ ও বিচিত্র সব বৈশ্বিক অনুষঙ্গকে প্রবন্ধের বিষয়ীভূত করা তাঁর জন্যে সহজ হয়ে যায়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ হয়ে ওঠে বিচিত্র জ্ঞানের ভাণ্ডার। বিচিত্র বিষয়ে প্রবন্ধ লিখলেও জাতীয়তাবাদ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদের বিষয়গুলো সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সর্বাধিক আগ্রহের জায়গা। তাঁর একাধিক বইয়ের নামেই বাঙালি ও জাতীয়তাবাদ শব্দ দুটি প্রাধান্য পেয়েছে। ‘বাঙালীর খোঁজে’, ‘বাঙালীকে বাঁচাবে কে ?’, ‘দ্বি-জাতিতত্তে¡র সত্য-মিথ্যা’, ‘জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন’, ‘জাতীয়তাবাদের স্বভাব-চরিত্র’, ইত্যাদি শিরোনামের প্রবন্ধগুলো পড়লে অনুধাবন করা যায়, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একইসাথে আধুনিক ও শেকড়সন্ধানী পর্যবেক্ষক; বাঙলা, বাঙালি এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ যাঁর লেখালিখির প্রধান চারিত্র্য নির্মাণ করেছে। ‘বাঙালীর খোঁজে’ নামের গদ্যে শিল্পী কামরুল হাসানের অকৃত্রিম বাঙালিত্বকে তুলে ধরার ভেতর দিয়ে একইসঙ্গে ঐতিহ্যানুসারী ও স্বদেশপ্রেমী যথার্থ বাঙালির বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধান করেছেন সিরাজুল ইসলাম। তাঁর কোনো রচনায় সমাজতান্ত্রিক চেতনা আর বৈষম্যহীন সাম্যবাদী সমাজের আকাক্সক্ষা অব্যক্ত থাকে না। সমাজতন্ত্রেই মানুষের প্রকৃত মুক্তি হলেও আমাদের সমাজতান্ত্রিক নেতারা যে জনগণের ভাষা রপ্ত করতে পারেননি, জনগণকে সেই স্বপ্ন দেখাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন, সেটাও বলতে ভোলেন না তিনি। ‘বাঙালীকে বাঁচাবে কে ?’ প্রবন্ধে বলেছেন-- 'মার্কসবাদ-লেনিনবাদের যে চর্চা আমাদের দেশে এ-পর্যন্ত হয়েছে তার ত্রুটি দু’রকমের। যান্ত্রিককতার ও আপোষকামিতার। যাঁরা খুবই ঋজু, আপোস করেন না, তাঁরা যান্ত্রিক হয়ে পড়েন, তত্ত¡কে বাস্তবে প্রয়োগ করার পথটা কী তা ভাবেন না। মার্কসবাদ যে বিজ্ঞান, তাকে যে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে ক্রমাগত, সেই বিষয়টা তাঁরা দেখেন না। তত্ত¡কে স্থান ও কালে নিয়ে আসেন না, স্থান ও কালকে তত্তে¡র দিকে নিক্ষেপ করেন। আর যাঁরা আপোসকামী তাঁদের কথা লোকের মন টানে না ওই আপোসকামিতার টানেই। জনগণ সাড়া দেয় না, তারা ভাবে যদি বুর্জোয়াপন্থীই হতে হয় তবে বুর্জেঅয়াদের দল করাই ভালো, সেখানে বড়র সঙ্গে থাকার অহঙ্কারটা জুটবে। প্রকৃত-প্রস্তাবে সমাজতান্ত্রিক দর্শন যে বুর্জোয়া অপেক্ষা উন্নততর, এর মধ্য দিয়ে সকলের জন্য সুখকর স্বদেশ গঠন সম্ভব, এই চেতনাটি আমাদের বামপন্থী নেতারা দেশের জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে পারেননি। ফলে সাধারণ মানুষও সমাজতন্ত্রের পথে পা বাড়াতে বিশেষ ভরসা পাননি। আমরা জানি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র দ্বি-জাতিতত্ত্ব নামক ভ্রান্ত একটি তত্তে¡র উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়, ফলে একই বাংলাদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটো রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত হয়। হিন্দু-মুসলিম এই দুটো যে ধর্মীয় সম্প্রদায়মাত্র, আলাদা কোনো জাতি নয়; এই কথাটি জিন্নাহ সাহেবেরা বুঝতে দেননি সাধারণ মানুষকে। বরং পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা মুসলমান হলেও তারা যে বাঙালি নয়, ভিন্ন একটি জাতি, তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ভিন্নতর, এই সত্যটি অচিরেই বাঙালির সামনে এসে ধরা দিলো। পাকিস্তানের বাঙালিদের জন্য অচিরেই সৃষ্টি হলো অস্তিত্বের সংকট। সেই সংকট দূর হলো রক্তক্ষয়ী এক মুক্তিসংগ্রামের ভেতর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে অভ্যুদয়ে, যে-জয়ের নায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই দ্বি-জাতিতত্ত¡ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে একটু ভিন্ন দিকে আলো ফেলতে চেয়েছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বলেছে-- ‘মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতিতত্ত¡ ভ্রান্ত ছিলো। কতটা ভ্রান্ত ? ততটাই ভ্রান্ত, যতটা সত্য ছিলো শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বি-জাতিতত্ত¡’ [‘দ্বি-জাতিতত্তে¡র সত্যমিথ্যা’]। প্রশ্ন উঠতে পারে- জিন্নাহর দ্বি-জাতিতত্ত¡ তো সকলেই জানেন, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বি-জাতিতত্ত¡ আবার কী ? শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বি-জাতিতত্ত¡ বলতে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাঙালি ও অবাঙালি দুই জাতির স্বতন্ত্র দুটি অস্তিত্বের কথা বলেছেন। অর্থাৎ জিন্নাহ যেটাকে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বলে ফেনা তুলেছেন, সেটা ভুল তত্ত্ব ছিলো; বরং মুখে না-বললেও শেখ মুজিবুর রহমান যে বাঙলি জাতির স্বাধিকারের জন্য লড়াই করেছেন, সেখানে যে বাঙালি-অবাঙালি দুটো জাতি ছিলো, এটা অনেক বেশি সত্য ছিলো। জিন্নাহর ভুলকে শুধরাতে এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু এতেই কি দ্বি-জাতিতত্তে¡র ভূত মাথা থেকে চলে গেল ? ইতিহাসের থেকে একাধিক উদাহরণ টেনে এনে সিরাজুল ইসলাম দেখিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দ্বি-জাতিতত্ত্ব টিকে থাকে, মনুষ্যত্বের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধা দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশেও সেই দ্বি-জাতিতত্ত্বকে দাঁড় করিয়েছেন স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, অন্য এক বাস্তবতার আলোকে। সিরাজুল ইসলামের মতে নতুন দুটো জাতি হলো-- ধনী ও গরিব। এই দুটি শ্রেণির মধ্যে যে-ব্যবধান, সেটাইকেই নব-উদ্ভূত দ্বি-জাতিতাত্তি¡ক সমস্যা বলে আখ্যায়িত করেছেন তিনি। সমাজতন্ত্র যেমন বলে পৃথিবীতে দুটো সম্প্রদায়-- শোষক ও শোষিত; শোষকরা ধনিক শ্রেণির আর শোষিতরা গরিব। সিরাজুল ইসলামও সেই কথাটাই বললেন, একটু ভিন্নভাবে। তাঁর এই আলোকপাত যে সমাজতান্ত্রিক চেতনা থেকে প্রসূত ও বুর্জোয়া বিরোধী ভাবনা থেকে প্রকাশিত, সেকথা বলাই বাহুল্য। এই বুর্জোয়া বিরোধী ভাবনা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রায় সকল রচনাতেই প্রতিফলিত। জাতীয়তাবাদের আলোচনার ভেতরেও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের হাত ধরে ঢুকে পড়েছেন পুঁজিবাদবিরোধী প্রশ্নশীলতায়। খুঁজেছেন জাতীয়তাবাদের শত্রুকে। পরাধীন দেশে জাতীয়তাবাদের শত্রুকে সহজেই চিহ্নিত ছিলো, কখনও ইংরেজ, কখনও পাঞ্জাবি, কখনও আবার হিন্দু-মুসলমানও পরস্পরের শত্রু হয়েছে; কিন্তু স্বাধীন দেশে ? লেখক বলেছেন-- ‘স্বাধীনতার আগে শত্রুকে চিহ্নিত করা সহজ ছিলো। শত্রু হচ্ছে পাঞ্জাবী। সে আমাদের শোষণ করে। সোনার বাংলা শ্মশান বানায়। সেই দুর্বৃত্তের চেহার আমরা দেখেছি খুব কাছের থেকে, ঘাড়ের ওপর তার থাবা টের পেয়েছি, দেখেছ- একাত্তরে। কিন্তু তারপরে ? তারপরে শত্রু কে ?’[‘জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন’]। স্বাধীন দেশে শত্রু খুঁজতে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন জাতীয়তাবাদই জাতীয়তাবাদের আসল শত্রু। এদেশের প্রধান দলগুলো জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করে, কিন্তু তারা একে-অপরকে তো শত্রু হিসেবেই দেখে। এবং তারা উভয়ই বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি, পুঁজির প্রতিভূ। তারা আলাদা আলাদা রাজনীতি করে বলে নয়, তাদের চিন্তা-চেতনায় জনকল্যাণমুখী কোনো ঐক্য নেই। জাতীয়তাবাদী হলেও তাদের ভেতরে জাতিগত ঐক্যচেতনা অনুপস্থিত। শিক্ষা-সংস্কৃতি-অর্থ প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে এই অনৈক্য, জাতীয়তহীনতার কথা বলতে গিয়ে সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন- ‘সমাজে, অর্থনীতিতে, সংস্কৃতিতে এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি যা ফলে জাতীয়তাবাদী ঐক্য দৃঢ় হবে, এমনকি সম্ভব হবে। সকলে এক ভাষা ব্যবহার করে না, এক ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যায় না, একই রকমের সংস্কৃতিতে লালিত-পালিত হচ্ছে না। স্বাধীনতা সব মানুষকে মুক্তি দেয়নি। স্বাধীনতা ক্রয়ের ব্যাপার নয়, চূড়ান্ত বিচারে অর্জনেরও নয়, স্বাধীনতা আসলে গড়ে তুলবার বিষয়। নিচ থেকে ধাপের ধাপে গড়ে তুলতে হয়। সে কাজে আমরা নিযুক্ত রয়েছি এমন কথা বলা যাবে না।’[‘জাতীয়তাবাদের স্বভাব-চরিত্র’]। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা যে সকলের স্বাধীনতা হয়ে ওঠেনি, সকল মানুষকে মুক্তি দেয়নি- এটা তো গভীর অনুধাবনে সত্য হয়ে ওঠে। এখানেও সেই সমাজতান্ত্রিক চেতনায় শ্রেণিবৈষম্যহীন সাম্যবাদী সমাজের ইঙ্গিতই বর্তমান। বস্তুত, সিরাজুল তাঁর সকল রচনাতেই বামপন্থী চেতনা ও পুঁজিবাদবিরোধিতা অব্যাহত রাখেন। এমনকি সাহিত্য ও সাহিত্যিকের আলোচনাপ্রসঙ্গেও তিনি পুঁজিবাদের কথা বলতে ভোলেন না। শেক্সপিয়ার, ড্যানিয়েল ডিফো প্রমুখ বিশ^খ্যাত ইংরেজ লেখকরাও যে পুঁজিবাদের এক-একজন সাংস্কৃতিক স্থপতি, যুক্তিসহকারে তা দেখিয়েছেন তিনি। ডিফো’র আলোড়িত চরিত্র রবিনসন ক্রুশো যে ঔপনিবেশিক যুগের পুঁজিবাদেরই একজন মুখপাত্র রূপে মানুষের কাছে হাজির হয়েছে, উদাহরণযোগে সেটা দেখিয়েছেন প্রাবন্ধিক। প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ হিসেবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বিশেষ একটি আগ্রহের জায়গা হলো শিক্ষা। এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বিবিধ সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি। ‘হৃদয়ে শিক্ষা চাই’ এমন শিরোনামের একটি প্রবন্ধে শিক্ষার তিনটি সাধারণ উদ্দেশ্যের উল্লেখ করেছেন তিনি- চাকুরিজীবী সৃষ্টি করা, সংস্কৃতিবান ভদ্রলোক সৃষ্টি করা এবং বিবেকবান ও সৃজনশীল মানুষ সৃষ্টি করা। কিন্তু চাকুরিজীবী হলেও, কিছু কিছু সংস্কৃতিবান ভদ্রলোক সৃষ্টি হলেও তৃতীয় উদ্দেশ্য- বিবেকবান ও সৃজনশীল মানুষ সৃষ্টি করার বিষয়টি কি এই শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে করা সম্ভব হয়েছে ? উত্তরে ‘না’-এর প্রভাব যে অধিক, এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমরা জানি, শিক্ষার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য মানুষ হওয়া বা মনুষ্যত্ব অর্জন করা, কিন্তু সেদিকে আমাদের আগ্রহ কতটুকু ? জনাব চৌধুরী বলেন- ‘চাকুরে নয়, ভদ্রলোক নয়ও, মানুষ সৃষ্টি করাই যে শিক্ষার মূল কথা হওয়া উচিত এই সত্যটা সকলেই মান্য করেন, কিন্তু সত্য মান্য করা আর সত্যিকার মানুষ সৃষ্টি করা এক নয়।’ সত্যিকার মানুষ সৃষ্টি করতে হলে শিক্ষাটাকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করতে হবে। তবে এই হৃদয়ের শিক্ষাকে কেবল হৃদয়ের আবেগ দিয়ে দেখলে চলবে না, এর সঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তা-চেতনার যোগ থাকতে হবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন আধুনিক সাহিত্যে বিজ্ঞানকে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন, সিরাজুল ইসলামও তেমনি হৃদয়ের শিক্ষার সঙ্গে বিজ্ঞান ও কারিগরি প্রযুক্তির সমন্বয়ের কথা বলেছেন। এহেন সমন্বয়ের ভেতর দিয়ে যে শিক্ষার জন্ম হবে, তা দিয়ে দেশের দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হবে। জনাব চৌধুরীর বলেছেন- ‘এমন শিক্ষিত হৃদয় চাই বাংলাদেশে যে হৃদয় দারিদ্র্যকে ঘৃণা করবে আন্তরিকভাবে, যে হৃদয় শুধু ক্রন্দন করবে না বা ক্রুদ্ধ হবে না, ক্রন্দন ও ক্রোধকে একত্র করে উদ্যত হবে ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তনকে সম্ভব করে তুলতে।’ [বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ]। বাংলাদেশ যেমন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রচুর তেমনি এদেশে ধনী-গরিবের বৈষম্যও বিশাল। বিশ^বিদ্যালয়ের কাজ কেবল জ্ঞান আহরণের ও বিতরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটাকে কাজে লাগিয়ে সমাজের দারিদ্র্য দূরীকরণের পথপ্রদর্শনেরও। আর হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে থাকবে স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশ। নানান মত প্রকাশের সুবিধা থাকতে হবে সেখানে, শিক্ষাদানের স্বাধীনতা থাকতে হবে শিক্ষকের। তাঁর মান-মর্যাদা রক্ষার ক্ষমতা থাকতে হবে, কোনো ভয়ের পরিবেশ থাকলে চলবে না; আর সবচেয়ে বড়ো কথা যেটা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কায়েমি স্বার্থ পূরণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবহৃত হবে না, এর কাজ হবে নতুন মানসিকতাসম্পন্ন সৃজনশীল মানুষ তৈরি করা। এটা না-হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সার্থকতা নেই। ‘অসার্থক শিক্ষালয় থাকার চেয়ে না-থাকাই ভালো’- বলে মন্তব্য করেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার পাশাপাশি সাহিত্য নিয়েও গদ্য লিখেছেন সিরাজুল ইসলাম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো সাহিত্যেরও স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি তুলেছেন তিনি। শুধু বিষয় ও বক্তব্যের বিচারেই নয়, ভাষার নান্দনিকতার গুণেও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক। #প্রথমাডটকমকথাপ্রকাশবুকরিভিউপ্রতিযোগিতা